ভাইরাল
বেলুচিস্তান কেন স্বাধীনতা চায়? ইতিহাস, বিদ্রোহ ও পাকিস্তানের দমননীতি

“পাঞ্জাবিদের শাসন করো, সিন্ধিদের ভয় দেখাও, পশতুদের টাকা দিয়ে কিনে নাও, আর বালুচদের সম্মান করো”—ব্রিটিশ শাসকদের এই নীতিতে স্পষ্ট ছিল, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে এক রকমভাবে শাসন করা যায় না। বালুচ ও পশতুদের নিয়ে তাদের ছিল বাড়তি উদ্বেগ। কারণ, এই দুই জাতির মধ্যেই ছিল অবাধ্যতা, লড়াইয়ের মানসিকতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব।
শুরুতে বলপ্রয়োগ করে শাসনের চেষ্টা করলেও, ১৮৪২ সালের কাবুল পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা উপলব্ধি করেছিল—শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, কৌশল দিয়েই এই গোষ্ঠীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই শুরু হয় “ভাগ করো ও শাসন করো” নীতি। গোত্রে গোত্রে বিভাজন, ভাতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ এবং নিজেদের স্বার্থে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করার ছক।
বালুচদের ক্ষেত্রে একদিক থেকে কাজটা ছিল সহজ। কারণ, তারা সরাসরি ধর্ম নয়, বরং ভূমি, গোত্র এবং সরদারের প্রতি ছিল বেশি অনুগত। সেই সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা কিছু গোত্রপ্রধানকে বিশেষ সম্মান ও ক্ষমতা দেয়, যেমন কালাতের খান। কিন্তু কিছু বালুচ গোত্র ছিল বরাবরই বিদ্রোহী, যাদের ব্রিটিশরাও বশে আনতে পারেনি—মাররি, বুগতি গোত্রের মতো।
আরোও পড়ুন – বালোচিস্তানের ইতিহাসে প্রথম: হিন্দু নারী কশিশ চৌধুরী হলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার
১৯৪৭-এ পাকিস্তানের জন্ম এবং নতুন শাসনব্যবস্থার আগমন বালুচদের জন্য তৈরি করল নতুন প্রশ্ন: সম্মান, অধিকার ও পরিচয়—সবই কি হারাতে বসেছে? যদিও প্রাথমিকভাবে বালুচ জাতীয়তাবাদ অতটা সংগঠিত ছিল না, তবুও সংগঠন যেমন ‘আঞ্জুমান-ই-ইত্তেহাদ-ই-বেলুচিস্তান’ বা ‘কালাত স্টেট ন্যাশনাল পার্টি’ আলাদা অস্তিত্বের চেতনায় জোর দিল।
এক বড় ঘটনা হয়ে ওঠে “স্ট্যান্ডস্টিল অ্যাগ্রিমেন্ট”, যেখানে কালাতকে পাকিস্তানের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে চাপে ফেলে “অ্যাকসেশন”-এ সই করিয়ে নেওয়ার পরই শুরু হয় বেলুচ বিদ্রোহের প্রথম অধ্যায়—প্রিন্স আবদুল করিমের নেতৃত্বে ১৯৪৮-৫০ বিদ্রোহ।
পাকিস্তানের ‘ওয়ান ইউনিট’ নীতির মাধ্যমে বালুচরা হয়ে পড়ে আরও কোণঠাসা। যাদের ব্রিটিশরা একসময় সম্মান জানাত, তারা পাকিস্তানে এসে পরিণত হল শুধুই এক ‘সম্পদভান্ডার’-এ—গ্যাস, খনিজ আর সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
বারবার বেলুচ বিদ্রোহকে “বিদেশি ষড়যন্ত্র” বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে পাকিস্তান—প্রথমে ভারত, পরে আফগানিস্তান। অথচ বাস্তব হল, বেলুচ বিদ্রোহের পেছনে মূলত রয়েছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অবহেলা, শোষণ ও দমননীতি।
‘জাফর এক্সপ্রেস’ ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা হয়তো আন্তর্জাতিক নজর টানবে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান আবারও ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে দাগিয়ে দেবে বিদ্রোহকে। নিজেদের ভুলে তৈরি দানবকে দেখে না তারা, স্বীকার তো করেই না।
যদি পাকিস্তান এ সমস্যার গভীরে না দেখে, তাহলে আগামী দিনগুলোয় শুধুই আরও অস্থিরতা অপেক্ষা করছে। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে—বালুচরা সম্মানের জন্য লড়াই করে। কিন্তু পাকিস্তান কি সেই ইতিহাসের পাঠ নিতে প্রস্তুত?