রাজনীতি
রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় বাম, বিজেপি, কংগ্রেস নেতৃত্ব
বেঙ্গল এক্সপ্রেস নিউজ : দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে বামপন্থীদের সঙ্গেও শেষদিন পর্যন্ত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সমান সখ্যতা ছিল। শুধু বামেরাই নয়, তাঁর প্রাক্তন দল কংগ্রেস এবং বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। তাই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে মর্মাহত সমস্ত রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিত্বরাই।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা বর্তমানে বামেদের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য্য বলেছেন, ‘রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও ব্যক্তিগত স্তরে উনি কখনও বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেননি। এটা ওঁর চরিত্রের বড় দিক। আমি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরই মেয়র হয়েছিলাম। সেই সময় উনি আমাকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন।’ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। রাজনৈতিক মহীরুহের পতন। মাননীয় সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে উনি সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মন্ত্রিসভায় ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে তিনি বাংলার অন্যতম একজন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় ইন্দিরা গান্ধীর খুব কাছের ব্যক্তি ছিলেন। ঈশ্বরের কাছে ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। এবং ওঁর পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের এই দুঃখ সওয়ার মতো শক্তি ঈশ্বর প্রদান করুক, এই প্রার্থনা করছি। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অনুসারী হলেও আমাদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য ছিল। ওঁর রাজনৈতিক জীবন সত্যিই ঈর্ষণীয়।
‘ একদা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সতীর্থ তথা বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁর শোক বার্তায় বলেছেন, ‘বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ ক্যাবিনেট মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাহত। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য, ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের সমবেদনা জানাচ্ছি। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। ওম শান্তি।’ দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা, বন্ধু এবং কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য্য তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘সুব্রত মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিনের পরিচিত একটি সংগ্রামী নাম। আমার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। এবং সেই সম্পর্কটা শুধু রাজনীতির সম্পর্ক নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল। তাই আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবনা এবং রাজনৈতিক গণ্ডি এমন ভাবে তৈরি করে দিয়েছিল, আমরা কেউ একজনকে আরেকজনের থেকে আলাদা বলে ভাবতেই পারতাম না। রাজনীতির খেলায় আমরা কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। কিন্তু অন্তরের মিল একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়।
বরং অনেক গভীরে ছিল। আমার স্মৃতিতে অসংখ্য ঘটনা ভেসে ওঠে। আমরা তখন সকলেই হার্ডিং হোস্টেলের ছাত্র। একটা ঢোলা প্যান্ট পরে, সাদা জামা গায়ে দিয়ে ট্রাম লাইনে দাড়িয়ে ও চিৎকার করে বলতো, ট্রাম লাইন আটকাতে হবে চলে আয়। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে নিয়ে আমরা পনেরো-কুড়ি জন ছেলে মিছিল করতাম। সকলে ভাবত এরা কি পাগল, এই কয়েকজন ছেলে মিলে এই লড়াই করতে নেমেছে! সুব্রত কিন্তু কোনদিনই ভয় পায়নি। ও বার বার বলতো- দেখবি একদিন রাইটার্স বিল্ডিঙে আমরা ঢুকবো। সত্যিই ঢুকেছিল। সুব্রতর মধ্যে রাজনীতির একটা মন গড়ে উঠেছিল। রাজনীতির সঙ্গে ওর একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। আর সেই সম্পর্ককে আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারিনা। রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রেখেও ও মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলতো যা অনেকের পছন্দ হতো না। কিন্তু ও মনে করত ও যেটা বিশ্বাস করে সেটাই করছে।
কিন্তু এসবের ঊর্ধ্বে যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সুব্রত চলে যাওয়াতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি সেই সম্পর্কের টানে। আমি মনে করি, বাংলার রাজনীতিতে সুব্রত উল্লেখযোগ্য নাম শুধু নয়, সুব্রত সেই ধরনের রাজনীতিবিদ যে শুধু রাজনৈতিক চিন্তাকেই বড় করে দেখতো। রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে কখনও ব্যক্তিগত শত্রুতাকে টেনে আনেনি। এটাই ছিল ওর রাজনৈতিক জীবনের সবথেকে বড় অধ্যায়। সেই কারণেই ওর প্রতি আমাদের একটা গভীর আকর্ষণ ছিল। বন্ধুত্বের ভাবছিল। যা পঞ্চাশ বছরেও নিশ্চিহ্ন হয়নি। তাই ওর মৃত্যুতে আমি সত্যিই গভীর ভাবে শোক সন্তপ্ত। আমি মর্মাহত।’