লাইফ স্টাইল
জেনে নিন সিজারিয়ান মায়ের কোমর ব্যথার কারণ ও করণীয়
বহু সিজারিয়ান মায়েরাই সন্তান জন্মদানের পর পরই কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রসবের কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যথা শুরু হয় এবং এর পর কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী ব্যথা প্রতিনিয়ত থেকে যায়।

মহিলাদের গর্ভকালীন সময়ে ওজন বৃদ্ধি, হরমোনের ব্যাপক পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে বহু মহিলাই কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন। তবে পারিবারিক সুত্রে অনেকেই এ ব্যাপারে গর্ভবতী হবার আগেই জানেন তবে, সি – সেকশনের পর প্রসবোত্তর কোমর ব্যথা সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। এই প্রতিবেদনে আমরা এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ করবো এবং জানবো।
বহু সিজারিয়ান মায়েরাই সন্তান জন্মদানের পর পরই কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রসবের কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যথা শুরু হয় এবং এর পর কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী ব্যথা প্রতিনিয়ত থেকে যায়।
সিজারিয়ান মায়ের সেকশনের পর কোমর ব্যথার কারণ
* হরমোনগত পরিবর্তনের কারনে কোমর ব্যাথা
মহিলাদের গর্ভাবস্থায় শুধু পেটের আকারই বাড়ে, এমন না এর পাশাপাশি নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়ে থাকে, যা দৃশ্যগত না হলেও কিন্তু, সন্তান জন্মের পর কোমর ব্যথায় ভুমিকা রাখতে পারে। মহিলাদের গর্ভাবস্থায়, শরীরকে প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে মহিলাদের রিলাক্সিন নামক একধরনের হরমোন নিঃসরিত হয়। এই হরমোনের নিঃসরণের ফলে শরীরের জয়েন্ট এবং লিগামেন্ট কিছুটা আলগা হয়ে যায়, যাতে গর্ভের শিশুকে ধাক্কা দেওয়া সহজ হয়। আপনার স্বাভাবিক প্রসব হোক বা সি সেকশন হোক, মহিলাদের শরীরে সন্তান প্রসবের সময় এই হরমোন নিঃসরিত হবেই। যেহেতু জয়েন্ট এবং লিগামেন্ট আলগা হলে বায়োমেক্যানিক্যালি আপনার কোমরে চাপ দেওয়া সহজ হয়ে যায়, তাই এই কার্যকলাপেও আপনার কোমরে ব্যথা অনুভুত হতে পারে। তবে ভালো খবর হচ্ছে, সন্তান জন্মদানের পরবর্তী কিছু মাসের মধ্যেই আপনার জয়েন্ট, মাংশপেশি এবং লিগামেন্ট ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠে।
* ওজন বৃদ্ধির কারনে কোমর ব্যাথা
সিজারের পর মহিলাদের কোমর ব্যথার অন্যতম কারণ হলো শরীরে অতিরিক্ত ওজন বহন। গর্ভাবস্থায় আপনার ওজন বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কারন আপনার ভিতরে সম্পুর্ন নতুন একজন মানুষ বেড়ে উঠছে। কিন্তু এই বাড়তি ওজন এর কারণে আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় যে ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দু থাকে, তা স্থানান্তরিত হয়ে মেরুদণ্ড ও কোমরে চাপ পড়তে পারে, যার কারণে কোমর এ ব্যথা হতে পারে।
* বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার কারনে কোমর ব্যাথা
গর্ভবতী মহিলাদের বাচ্চার ওজন মাত্র ছয় থেকে সাত পাউন্ড হতে পারে যা আপাতদৃষ্টিতে খুব বেশি কিছু না কিন্তু আপনার শরীরের জন্য এটি অতিরিক্ত ওজন যা আপনি প্রতিদিন বহন করছেন।
পাশাপাশি, বাচ্চাকে বিছানা থেকে তুলে কোলে নেওয়ার জন্য আপনাকে ক্রমাগত ঝুঁকতে হচ্ছে। এই কারণে আপনার মেরুদন্ডে চাপ পড়ার ফলে কোমর ব্যথা হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জেনে নিন একজন সিজারিয়ান মায়ের খাবার তালিকা সম্পর্কে
* বুকের দুধ খাওয়ানোর কারনে কোমর ব্যাথা
দীর্ঘসময় ধরে মহিলাদের বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর কারণে ঘাড়ে চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে ঘাড়ে ব্যথার সৃষ্টি করে। এই ব্যথা ঘাড় থেকে কোমরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যাকে মেডিকেলের ভাষায় “রেডিয়েটিং পেইন” বলে। বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় যদি আপনার পশ্চার ভালো না থাকে, বিশেষ করে যদি আপনার কাঁধ বাচ্চার দিকে ঝুঁকে থাকে, তাহলেও আপনার কোমর ব্যথা হতে পারে।
* এনেস্থেশিয়ার প্রভাবে কারনে কোমর ব্যাথা
সি - সেকশনের আগে মহিলাদের কোন ধরণের এনেস্থেশিয়া থাকলে, তার উপর ও প্রসব পরবর্তী কোমর ব্যথা হবে কিনা, নির্ভর করে। মহিলাদের অস্ত্রোপচার এর জায়গাটিতে এপিডুরাল বা স্পাইনাল ব্লক দেওয়া হতে পারে। এপিডুরাল ক্যাটাগরিতে, ডাক্তার মহিলাদের মেরুদন্ডের আশেপাশের জায়গায় এনেস্থেশিয়া ইনজেকশন দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, স্পাইনাল ব্লকে, মেরুদন্ডের খুব কাছে এনেস্থেশিয়া ইনজেকশন দেওয়া হয়। স্পাইনাল ব্লক খুব দ্রুত কাজ করে। এপিডুরাল এর কার্যকারিতা শুরু হতে ২০ মিনিটের মতো লাগে। কোন ক্যাটাগরির এনেস্থেশিয়া ব্যবহার করা হয়েছিলো, তা প্রসব পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
এপিডুরাল বা স্পাইনাল ব্লক ব্যবহার করার একটি জটিলতা হলো, প্রসবের পর তারা মেরুদন্ডের কাছাকাছি অবস্থিত মাংশপেশিকে শক্ত করে ফেলতে পারে (স্পাজম)। মাংশপেশির এর অস্বাভাবিকতা প্রসবের পর কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী চলতে থাকে, যার কারণে কোমর ব্যথা সহ অন্যান্য জায়গাতেও ব্যথা অনুভুত হতে পারে।
সিজারের পর কোমর ব্যথায় সিজারিয়ান মা কি করতে পারেন ?
সিজারের পর কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সিজারিয়ান মায়েরা যা যা করতে পারেন:
সিজারিয়ান মা বাচ্চাকে কোলে তোলার সময় ঝুঁকবেন না
আপনার অঙ্গভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন হন। আপনার পিঠ সোজা রাখুন। আপনার অসুবিধা হলে বাচ্চাকে কোলে থেকে নামিয়ে বিছানায় বা সমতলে রাখতে অন্য কারো সাহায্য নিন।
সিজারিয়ান মায়েরা সন্তানকে স্তন্যপানের সময় পিঠ সোজা রাখুন
এর ফলে সিজারিয়ান মায়ের ঘাড় ও মেরুদন্ডে চাপ প্রশমিত হয়। যার কারণে কোমর ব্যথা প্রতিহত হয় এবং ব্যথা থাকলেও তা কম অনুভুত হয়। স্তন্যপানের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করুন।
সিজারিয়ান মায়েরা গরম জলে স্নান করুন
হালকা কুসুম গরম জল দিয়ে স্নান করলে মাংশপেশির টান বা শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে যে ব্যথা অনুভুত হয়, তা খানিকটা কমে যায়। আর্দ্র তাপ রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়, যার কারণে প্রদাহের সাথে সাথে ব্যথাও কমে। যেহেতু সি- সেকশন একটি বড়সড় সার্জারি, তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত ডাক্তারের অনুমতি না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্নান করা যাবে না। তবে সিজারিয়ান মায়েরা কোমরে হিটিং প্যাড ব্যবহার করতে পারেন।
সি-সেকশনের মায়েরা একটু বেশি বিশ্রাম নিন
সি-সেকশনের পর খুব বেশি চলাফেরা করলে কোমর ব্যথা আরো বেড়ে যেতে পারে। নিজেকে বিশ্রাম করার সুযোগ দিন। যখনই সময় পাবেন, একটু ঘুমিয়ে নিন। ঘুমের মধ্যেই শরীর নিজেকে মেরামতের সুযোগ পায়। সদ্য জন্মানো বাচ্চার দেখভাল করতে যেয়ে অধিকাংশ সময়েই মায়েরা পর্যাপ্ত ঘুমানোর সুযোগ পান না।
হালকা ব্যায়াম শুরু করুন
প্রসব পরবর্তী কর্মঠ জীবন ব্যথা দূর করতে অনেকাংশে সাহায্য করে। ইয়োগা, পিলাটিস, মাঝারি গতিতে হাঁটা আপনার পেটের পেশিকে শক্তিশালী করে এবং কোমরের টান ছেটে দেয়। এখানে আমরা অল্প কিছু ব্যায়াম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি, যা আপনি কোন ধরণের সরঞ্জাম ছাড়াই যে কোন জায়গায় করতে পারবেন।
সিজারিয়ান মায়েরা বেলি ব্রিদিং করতে পারেন
১. বেলি ব্রিদিং এটি একটি চমৎকার রিলাক্সেশন টেকনিক। এই শিথিলকরণ কৌশলটি সিজারিয়ান মায়ের কোর মাসল গুলোকে একসাথে কাজ করতে পুনরায় প্রশিক্ষণ দেয়। এই ব্যায়ামটি করার সময় ট্রান্সভার্স এবডোমিনিস মাসল এর ব্যায়াম হয়।
ধাপ ১ - বিছানা বা সোফায় শুয়ে পড়ুন
ধাপ ২– আপনার হাত পেটের উপর রেখে শরীর শিথিল করুন।
ধাপ ৩ - নাক দিয়ে গভীর শ্বাস নিন, আপনার পেট যে শ্বাস নেওয়ায় সাথে সাথে প্রসারিত হচ্ছে, তা অনুভব করুন।
ধাপ ৪ – মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস ছাড়ার সময়, আপনার নাভিকে মেরুদন্ডের দিকে টানুন, সাথে আপনার পেটের পেশিগুলোকেও সংকুচিত করুন। ৩ সেকেন্ড ধরে রাখুন।
দিনে ৩ বার ৫ থেকে ১০ বার করুন।
২. সিটেড ক্রেগেল
গবেষনায় দেখা গেছে, প্রসবোত্তর পেলভিক ফ্লোর পেশিকে সক্রিয় করতে ক্রেগেল এক্সারসাইজ অসাধারণ কাজ করে। সি-সেকশনের পরে আপনার ইউরিনারি ক্যাথেটার থাকতে পারে। ক্যাথেটার অপসারণের পরে এই ব্যায়ামটি করবেন।
ধাপ ১- মেঝেতে পা রেখে চেয়ারে বসুন।
ধাপ ২– পেটের (পেলভিক ফ্লোরের) পেশিগুলোকে সংকুচিত করুন। প্রস্রাব আটকে রাখার চেষ্টা করছেন, এমন ভাবে করুন।
ধাপ ৩- যতক্ষণ সম্ভব, এই সংকোচনকে ধরে রাখুন। ৫ সেকেন্ড দিয়ে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে সময় বাড়িয়ে দিন।
ধাপ ৪ – গভীর শ্বাস নিন, তারপর শ্বাস ছাড়ুন। সংকোচনকে শিথিল করুন।
* দাঁড়িয়ে এবং শুয়েও ক্রেগেল এক্সারসাইজ করুন। প্রতিবার ২ মিনিটের বিরতিতে ৮-১২ বার এই ব্যায়ামটি করুন, দিনে দুইবার।
৩. ওয়াল সিট ( দেয়ালে বসা)
এই চমৎকার ব্যায়ামটি করলে একই সাথে কোয়াড্রিসেপস, হ্যামস্ট্রিং, পেলভিক ফ্লোর, কোর এবং পিঠের নিচের অংশের ( লোয়ার ব্যাক) মাসল গ্রুপের একসাথে কাজ হয়।
ধাপ ১– দেয়াল থেকে ১ - ২ ফুট দূরে সোজা হয়ে দাঁড়ান।
ধাপ ২- ধীরে ধীরে দেয়ালের দিকে ঝুঁকুন, নিজেকে বসার অবস্থানে নামিয়ে নিন। আপনার হিপ ও হাঁটু একে অপরের ৯০ ডিগ্রীতে থাকতে হবে।
ধাপ ৩ – গভীর শ্বাস নিন। শ্বাস ছাড়ার সময় ভাবুন, আপনি দেয়ালের দিকে আপনার নাভিকে টেনে নিচ্ছেন।
ধাপ ৪ – এই অবস্থানে পেটের পেশিগুলোকে সংকুচিত করে ক্রেগেল ব্যায়ামটি করতে পারেন।
যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখুন। ১ মিনিট বিরতি নিন। ৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
সিজারিয়ান মায়েরা শারীরিক গঠন ও অবস্থা অনুযায়ী কোমর ব্যথা দূর করতে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হলে নানাভাবে সাহায্য পেতে পারেন। তাই সিজারের পর কোমর ব্যথায় ভুগলে আজই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হোন।
ক্রেডিট – Dr. Sapia Akter (Physiotherapy Specialist)