বাংলার খবর
২৫০ বছরের পুরনো এগরার বাসাবাড়ির কালীপুজো আজও বহু ইতিহাসের সাক্ষ বহন করে চলেছে

বেঙ্গল এক্সপ্রেস নিউজ: এগরার বাসাবাড়ির কালী মন্দিরে এখন তুমুল ব্যস্ততা। প্রায় ২৫০ বছর আগে এগরার বাসাবাড়িতে শুরু হয় কালীপুজো। অনেকে নাম না শুনলেও বহু বড় বাজেটের পুজোর মধ্যে বাসাবাড়ির এই কালীপুজোর পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের কাছে বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।
কথিত আছে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা থানা এক কালে বঙ্গোপসাগরের বালুকাময় চরভূমি ছিল। সমুদ্রের তটভূমিতে ঝোপ জঙ্গল পাতার কুটির বেঁধে এগারো জন ধীবর সমুদ্রে মৎস্য শিকারের জন্য বসবাস করত। এই এগারো কথাটি থেকেই কালক্রমে ‘এগরা’ নামের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে ইংরেজ শাসনকালে অখন্ড মেদিনীপুরের পিংলা থানার (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত) গোবর্ধ্বনপুর গ্রামের নবকুমার বসু ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সবং, পিংলা ও পাঁশকুড়া থানার ৫০টি মৌজার জমিদারি পেয়েছিলেন। এবং নবকুমার বসু পাঁশকুড়ার জমিদার চন্দ্রশেখর বাড়ির কন্যাকে বিবাহ সূত্রে হলুদ তেলে ১৬টি মৌজার ১৬ আনা তালুক দানে পান।
সেই ১৬টি মহলার জন্য নবকুমার বসু পিংলা থেকে এগরা থানার (বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত) আকলাবাদে আসেন। এবং জমিদারী দেখভাল এবং রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে তিনি এগরায় অস্থায়ী খড়ের ছাউনির বাসগৃহ তৈরি করে বছরের কয়েকমাস থাকতেন আবার চলে যেতেন পিংলাতে। সেই থেকে জমিদারদের ওই বাড়ি বাসাবাড়ি নামে পরিচিত। তৎকালীন ধৈর্যোর সহিত রাজস্ব আদায় ও প্রজাদের সঙ্গে নিষ্ঠার আচরনের জন্য ইংরেজ বাহাদুর বসু পরিবারকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বসু চৌধুরী পরিবার ধার্মিক ও নিষ্ঠার পূজারি। তাই এগরার আকলাবাদে বসু চৌধুরী পরিবারের বাসাবাড়িতে তৎকালীন জমিদার নবকুমার বসু চৌধুরী শুরু করেন দক্ষিণা কালীর পুজো। যা আজও প্রাচীন রীতিমেনে হয়ে আসছে। বাসাবাড়ির পূর্ণ ভূমিতে পাশাপাশি দু’টো পুজা হয়।
যদিও এর কারণ আজকের বসু চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের কাছে অজানা। জমিদারদের সেকেলে জমিদারি প্রথা আজ আর না থাকলেও বাসাবাড়ির কালী পুজোয় আজও রয়ে গিয়েছে সেকালের পুজোর প্রাচীন নিয়ম-কানুন। পুজোর আগে মাকে রুপোর মুকুট, রুপোর খড়্গ্ ও স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত করা হয়। পুজোর সূচনাকাল থেকে আজও পাঁঠা বলির প্রথা আছে। কথিত আছে এখানে মায়ের কাছে বলির মানত করে অন্ধ তাঁর দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন, বোবা তাঁর বাকশক্তি ফিরে পেয়েছেন, বন্ধানারীরা পুত্রসন্তান লাভ করেছেন। এমনকি হারিয়ে যাওয়া সন্তান-সন্তোতিকেও ফিরে পেয়েছেন অনেকে। ভক্তদের মনস্কামনা পূরণ হলেই তারা মায়ের কাছে পাঁঠাবলি দিয়ে আসে। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, নিষ্কুড়ি ভোগ যা বাড়ির ব্রাহ্মনরাই তৈরি করেন।
ঐ ভোগ খেতে শুধু এগরা নয় পাশ্ববর্তী থানা গুলো থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় জমান। তবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে এ বাড়ির পুজোয়। আগে খড়ের ছাউনির ঘরে পুজা হতো। বতর্মানে দুই প্রান্তে দুটি সুচারু মন্দিরে মায়ের পুজো হয়। আগে প্রদীপ আর মশাল জ্বালিয়ে পুজো হতো, কিন্তু এখন আর মশাল জ্বালিয়ে নয় জেনারেটরের লাইটেই পুজো হয়। প্রতিবছর পুজোর একমাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এবছর পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। করোনার কারণে প্রশাসনিক নিয়ম মেনে দু-একজনকে নেয়েই শুরু হয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। প্রতি বছর বাড়ির সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর সমাগমে গম-গম করতো বাসাবাড়ি। কিন্তু করোনার কারণে এ বছর কারা আসবেন আর কারা আসবেন না, সেই নিয়েই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কমিয়ে দেওয়া হয়েছে পুজোর জাঁকজমক। সামাজিক দূরত্ব-বিধি মেনেই পুজো হবে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।