খেলা-ধূলা
জীবনের ২২ গজেও হাফসেঞ্চুরি ক্রিকেট ঈশ্বরের, আজও শচীনের বিকল্প খুঁজে চলেছে বিশ্ব

বেঙ্গল এক্সপ্রেস নিউজ: সালটা ১৯৮৯-৯০। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের খেলা দেখতে মাঠে উপস্থিত লতা মঙ্গেশকর। হঠাৎই তাঁর সঙ্গে দেখা সুনীল গাভাস্করের। ততদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি প্রাক্তনীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। সানিকে দেখামাত্রই আজীবন ক্রিকেটের বড় ভক্ত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘আপনি অবসর নিলেন, এখন আর আমি কার খেলা দেখব!’ উত্তরে, গাভাস্কার মাঠে ব্যাট করতে নামা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির ছোটখাটো চেহারার একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটাকে ভালো করে চিনে রাখুন। এবার থেকে আপনি এই ছেলেটারাই খেলাই দেখবেন।’
ভবিষ্যতে সেটাই বাস্তব হয়েছিল। যতদিন ওই ছোটখাটো চেহারার বাচ্চা ছেলেটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে শাসন করেছেন, ততদিন শুধুমাত্র তাঁর খেলাই দেখেছেন লতা মঙ্গেশকর। শুধু খেলা দেখাই নয়, সেই ছোটখাটো ছেলেটি তাঁর পুত্রসম এবং পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শচীন রমেশ তেন্ডুলকর।
আজ আরও একটা ২৪ এপ্রিল। দেখতে দেখতে জীবনের ৪৯টা বসন্ত পার করে ফেললেন মাস্টার ব্লাস্টার। ৫০তম জন্মদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা বিশ্ব থেকে আসা সমস্ত শুভেচ্ছা বার্তার ঠিকানা আজ একটাই। প্রায় সাড়ে আট বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সন্ন্যাস নিলেও আজও তিনি সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও তিনি সমস্ত ভারতবাসীর কাছে একটা আবেগ এবং একটা চরিত্র।
২৪ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে যিনি কোনদিন নিজের বয়স এবং রানের সংখ্যা গোনেননি, তাঁকে আর যাই হোক পারফরমেন্স বা বয়স দিয়ে মাপা যায় না। তিনি তার থেকেও অনেক উপরে। আর সেই জায়গাতেই শচীন তেন্ডুলকর বাকি সকলের থেকে আলাদা। ভারতীয় ক্রিকেটের নক্ষত্র মন্ডলে অনেক তারকা এসেছেন। অনেকেই সেই গ্যালাক্সিতে জায়গা করে নিয়েছেন। আবার অনেকেই কালের নিয়মে বিলীন হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সূর্যের মতো অমরত্ব লাভ করেছেন শচীন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২২ গজে তিনি নেই প্রায় সাড়ে ৮ বছর হয়ে গেল। কিন্তু আরেকটি শচীনকে এখনও পর্যন্ত দেখা গেল না। হয়তো কোনদিন যাবেও না।
আরও পড়ুন: রাসেল ধামাকাতেও জয় অধরা নাইটদের, প্লেঅফ থেকে ক্রমশ দূরে সরছে শ্রেয়সরা
পঙ্কজ রায়, বীনু মানকর, মনসুর আলী খান পতৌদি, সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, মহম্মদ আজহারউদ্দিন থেকে শুরু করে হালফিলের মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি- সবাইকেই ছাপিয়ে গিয়েছেন শচীন। ভারতীয় ক্রিকেটে যখনই কোনও নতুন তারকার জন্ম হয়েছে, তখনই তাঁর সঙ্গে শুরু হয়েছে শচীন তেন্ডুলকরের তুলনা। তাতেই বারবার প্রমাণিত, ‘ইস্ট অর ওয়েস্ট- শচীন ইজ দ্যা বেস্ট’। তিনি সবার থেকে আলাদা।
ক্রিকেট মাঠ হোক বা কোনও অনুষ্ঠানে, এখনও শচীনকে দেখতে পেলে একই রকম আবেগ দেখা যায় ১৩০ কোটি ভারতীয়র মধ্যে। এখনও গ্যালারি থেকে হোক বা আশেপাশে ভিড় করা জনতার মধ্য থেকে আবেগ মেশানো এবং গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই বহু পরিচিত ‘শচ-ই-ই-ন, শচ-ই-ই-ন’ আওয়াজটা ওঠে।’ গত ৩২ বছর ধরে যার ভলিউম একটুও কমেনি। আর এইখানেই শচীন সকলের থেকে আলাদা।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে করাচির মাঠে যেভাবে ওয়াসিম আক্রম, ইমরান খান, ওয়াকার ইউনুসদের আগুনে বোলিঙের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনই ক্রিকেটবিশ্ব বুঝে গিয়েছিল সুনীল গাভাস্কারের বিকল্প জন্ম নিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। ৯০ এর দশকে তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণ শুরু হয়েছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের রোমান্টিসিজম তাঁকে ঘিরেই।
আরও পড়ুন: দিল্লি শিবিরে আবারও করোনার হানা! আইসোলেশনে পাঠানো হল কোচ পন্টিংকে
শুধু ক্রিকেট নয়, সেদিনের ওই ১৭-১৮ বছর বয়সের ছেলেটির হাত ধরেই ভারতীয় অর্থনীতি ও বাণিজ্যে জোয়ার আসে। একের পর এক বিশ্বের নামিদামী সংস্থা শচীনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে ভারতে ব্যবসা শুরু করে। ভারতীয় বিজ্ঞাপনের বাজারে ঝড় ওঠে। আর ওই নামিদামী সংস্থাগুলোর মতো আপামর ভারতবাসীর শয়নে স্বপনেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নেন শচীন। ইমরান, ওয়াসিম, ওয়াকার, মাকগ্রা, ব্রেট লি,রবার্টস, হোল্ডিংস, বন্ড, অ্যান্ডারসনদের আগুনে বোলিংকে যেমন দৃঢ়তার সঙ্গে সামলেছেন ঠিক তেমনই শেন ওয়ার্ন, সাকলাইন মুস্তাক, মুথাইয়া মুরালিধরনদের রহস্যময় ঘূর্ণিকেও দাপটের সঙ্গে মাঠের বাইরে ফেলেছেন।
কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কারের হাত ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যখন ভারত প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে তখনই আবির্ভাব শচীনের। একের পর এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গড়ে গিয়েছেন একটার পর একটা রেকর্ড ও কীর্তি। সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বাধিক ৩৪ হাজারেরও বেশি রান হোক বা প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে এক ইনিংসে ২০০ রান করা বা সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি- সব রেকর্ডই জ্বলজ্বল করছে তাঁর নামের পাশে। তবুও তাঁর ফর্ম নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু যখন বগলে ব্যাট নিয়ে হাতে গ্লাভস পরতে পরতে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ২২ গজের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন, যখন সারা স্টেডিয়াম জুড়ে ‘শচ-ই-ই-ন, শচ-ই-ই-ন’ ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছে তখন সেই সমালোচকদের গায়েও কাঁটা দিয়েছে। তাঁর ফটো ফিনিশ স্ট্রেট ড্রাইভ ও কভারড্রাইভ গুলো বাউন্ডারি টপকেছে তখন সেই সমালোচকরাও আনন্দে লাফিয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। তাই শচীনকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করা যায়, তাঁকে কখনও উপেক্ষা করা যায় না।
আরও পড়ুন: শ্রমদফতর ও আইএফএ-এর যৌথ উদ্যোগে এবার উত্তরবঙ্গে টী গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট
দীর্ঘ ক্রিকেট কেরিয়ারে বিতর্ক তাঁকে কখনও ছুঁতে পারেনি। মাঠ এবং মাঠের বাইরে তিনি সবসময়ই আদর্শ। তাই ভারতীয় ক্রিকেটে যদি কোনও ধর্ম থেকে থাকে, তাহলে সেই ধর্মের ঈশ্বর অবশ্যই শচীন তেন্ডুলকর। ভারতীয় ক্রিকেটের ১০ নম্বর জার্সিটার হৃদয়ে চিরকাল থেকে যাবেন এই ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির মানুষটা। ভালো থাকবেন মাস্টারব্লাস্টার। ৫০তম জন্মদিনে বেঙ্গল এক্সপ্রেসের তরফ থেকে আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা রইল।