বাংলার খবর
রাতারাতি বদলে গেল বর্ধমানের বিশ্বজিতের জীবন, রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে এবার অধ্যাপনা করবেন

বেঙ্গল এক্সপ্রেস নিউজ: এতদিন নিজের হাতেই গড়ে তুলেছেন একের পর এক বাড়ি। আর সেই সমস্ত বাড়ি গড়তে গড়তেই নিজের স্বপ্নের ইমারতটাও গড়তে শুরু করেছিলেন বিশ্বজিৎ মন্ডল। মেমারি কলেজের সেরা ছাত্র। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস। বড়শুল, শক্তিগড়, কলানবগ্রামের বাসিন্দারা বিশ্বজিতের হাতেই বাড়ি তৈরির ভার নিশ্চিন্তে তুলে দিতেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিতেন বিশ্বজিৎ। তিনিও স্বপ্ন দেখতেন যে ভালো একটা চাকরি করবেন।
এবার তাঁর সেই স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে। কোদাল, বেলচা, করণিক ছেড়ে এবার বিশ্বজিতের হাতে উঠতে চলেছে চক, ডাস্টার। যে হাতে এতদিন একের পর এক বাড়ি তৈরি করেছেন, এবার সেই হাতেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে সমাজ গড়বেন। রাজমিস্ত্রির জীবন এবার অতীত। এবার কলেজে অধ্যাপনা করবেন তিনি। রাতারাতি বদলে গিয়েছে বিশ্বজিতের জীবন। আর এই খবরে খুশির হাওয়া গোটা এলাকায়। শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে হাজির হচ্ছেন চেনা-পরিচিত থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
বর্ধমানের বড়শুলের বকুলতলায় অ্যাজবেস্টারের দুই কামরার বাড়িতে বাবা-মাকে নিয়ে থাকেন বিশ্বজিৎ। বাবা রবীন মন্ডল এবং মা টুনি মন্ডল পেশায় দিনমজুর। নিজেরা পড়াশোনা না জানলেও ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। সেই মতো সিডিপি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন বিশ্বজিৎ। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে মেমারি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। ২০১৪ সালে কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০১৬ সালে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। মাঝে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা কোর্সও করেছিলেন বিশ্বজিৎ।
এরপর ২০১৭ সাল থেকে চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করেন বিশ্বজিৎ। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষায় একের পর এক বসেছেন। কিন্তু সাফল্য আসেনি। বাবা, মা সামান্য দিনমজুরের কাজ করায় অভাবের সংসার ঠিক ভাবে চলত না। এদিকে শত চেষ্টা করেও চাকরি না পাওয়ায় রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তাই সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়ে এক বন্ধুর সাহায্যে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী জায়গায় চাকরির চেষ্টাও করেছিলেন। তার মধ্যেই করোনা মহামারী চলে আসায় সব দরজাই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিশ্বজিতের কাছে। লকডাউন হয়ে যাওয়ায় বাবা-মায়ের কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই সংসারের হাল ধরতে পুরোপুরি কাজে নেমে পড়তে হয় বিশ্বজিৎকে। ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এমএ পাস করা বিশ্বজিৎ পুরোদমে হয়ে পড়েন রাজমিস্ত্রি।
তবে এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও হাল ছাড়েননি বিশ্বজিৎ। অবশেষে গত সোমবারই এত কষ্টের ফল পেলেন। গত সোমবার এলাকার একটি স্কুলের পিছনে কাজ করার সময়ই তাঁর কাছে ফোন আসে। ফোনটি করেছিলেন কলকাতা চিত্তরঞ্জন কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি বিশ্বজিৎকে তাঁর কলেজে পার্ট টাইম অধ্যাপনার কাজ করার প্রস্তাব দেন। এবং পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে বায়োডাটা এবং সমস্ত ডকুমেন্টস নিয়ে কলেজে দেখা করতে বলেন প্রিন্সিপাল।
বিকালে কাজ থেকে মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরেই বাবা-মাকে নতুন চাকরির প্রস্তাবের সুখবরটা দেন বিশ্বজিৎ। ছেলেকে অনুমতি দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি রবীন মন্ডল এবং টুনি মন্ডল। ছেলের এই নতুন চাকরির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিশ্বজিতের মা টুনি মণ্ডল বলেছেন, ‘ছেলের শিক্ষকতা করার অনেক দিনের শখ ছিল। সেই জন্য অনেক স্কুল-কলেজে পার্টটাইম শিক্ষকতা করানোর জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু কোনও জায়গা থেকেই ডাক আসেনি। অবশেষে ওর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।’ বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন আগামী দু-একদিনের মধ্যেই তিনি কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর আর রাজমিস্ত্রির কাজ নয়, অধ্যাপনাই করবেন।’